বেগম রোকেয়া যেমন বেঁটে (খাটো) ছিলেন তেমনি ছিলেন অন্ধ। বলা যায় বধিরও ছিলেন। তিনি চোখে সবকিছু দেখতেন না। আবার যা কিছু দেখেছেন তাও ত্রুটিপূর্ণ; তাই অন্যের উপর ভরসা করতে হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। বেগম রোকেয়া অন্ততঃ কোনো মুসলিম নারীর অনুসরণীয় হওয়ার যোগ্য নয়।
বেঁটে কীভাবে?
—(শারীরিকভাবে) বেঁটে হওয়া দূষণীয় নয়, (এটা আল্লাহর সৃষ্টি) কিন্তু মানসিকভাবে বেঁটে হলে অবশ্যই তা দোষ। শুধু দোষ নয়, তা গুরুতর দোষ। তিনি যে সময়টাতে জন্মেছেন তা ছিল, ভারতবর্ষের মুসলমানদের সবচেয়ে অধপতনের যুগ। দুইশত বছরের ইংরেজ শোষণে তখন সব শেষ প্রায়। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব-মাদরাসা ছিল। এই ৮০ হাজার মক্তব-মাদরাসার জন্য বাংলার চার ভাগের এক ভাগ জমি লাখেরাজভাবে বরাদ্দ ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই লাখেরাজ সম্পত্তি আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং জোর-জবরদস্তি করে দেশের হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের ইজারা দিতে থাকে। এসংক্রান্ত তিনটি বিধান হলো : (১) ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন—১৯, (২) ১৯১৮ সালের রেগুলেশন—২, (৩) রিজামসান ল অব ১৮২৮ (লাখেরাজ ভূমি পুনঃ গ্রহণ আইন)।
ফলে মাদরাসার আয় কমতে থাকে। বহু মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। গুটিকয়েক মাদ্রাসা কোনোভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৭৬৫ সালে বাংলায় মাদরাসার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার।
২০০ বছর পর ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে আসে।’ (এ জেড এম শামসুল আলম, মাদরাসা শিক্ষা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ : মে-২০০২, পৃষ্ঠা ৩-৪)
মাদ্রাসা শিক্ষাই ছিল ইংরেজ শাসনের পূর্বের শিক্ষাদীক্ষার প্রধান ব্যবস্থা। অন্ততঃ এতটুকু তো নিশ্চিত যে, মুসলমানদেরকে ইংরেজরা ইচ্ছেকৃতভাবে পিছিয়ে রেখেছিল। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছু থেকে ছিটকে ফেলা হয়েছিল। দুইশত বছরের শাসনে মুসলমানদের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ইংরেজরা তাদের নতুন শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজিয়েছে তাদের মতো করে। এতে কি মুসলমানদের শিক্ষার হার খুব বেড়ে গিয়েছিল? একদম না। মুসলমানরা পিছিয়েই ছিল। এতোটাই পিছিয়েছিল যে, দেখা যেত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের একটি কলেজের হিন্দু ছাত্র ৯৫% আর মুসলিম ছাত্র ৫%। বাংলার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন হিশেবে চোখ বুলালে স্পষ্ট হওয়া যায়।
লর্ড বেন্টিং-এর শাসনামলে উইলিয়াম অ্যাডাম বাংলা ও বিহারের ‘স্বদেশী শিক্ষাব্যবস্থা’ সম্পর্কে যে তিনটি রিপোর্ট পেশ করেন (১৮৩৫-১৮৩৮), তাঁর সর্বশেষ রিপোর্টটিতে তিনি জানান, মুর্শিদাবাদ জেলার বাংলা স্কুলের মোট ১ হাজার ৮০ জন ছাত্রের মধ্যে ৯৯৮ জন হিন্দু এবং ৮২ জন মুসলমান।
চিন্তা করতে পারছেন? মুর্শিদাবাদের মতো জায়গায় মুসলিম মাত্র ৮২জন!
ছেলে-মেয়ে প্রশ্ন কই রাখবেন? যেখানে ছাত্রই পড়া থেকে বঞ্চিত।
বেগম রোকেয়া এমন এক সময়ে এসে নারী শিক্ষার আওয়াজ তুললেন অথচ মুসলমানদের দুর্দশাকে তিনি বিন্দুমাত্র চেয়ে দেখলেন না। কেনো মুসলমানদের এই দুর্দশা তার কারণও খুঁজলেন না। তিনি যদি মানসিকভাবে লম্বা হতেন অবশ্যই বুঝতেন এবং খুঁজতেন।
যেখানে মুসলিম ছেলেরাই বঞ্চিত সেখানে মেয়েদের প্রসঙ্গ কতখানি যুৎসই? তাও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু মানুষ শিক্ষায় রত ছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ধর্মপ্রাণ কিছু মুসলিম পণ্ডিত ১৮৬৬ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে সার্বিকভাবে মুসলমানদের দশা ছিল বেহাল সেখানে রোকেয়ার এমন সুর কতখানি মানানসই ছিল?
জানেন কি? মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ছিলেন প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার। আঁচ করা যায় মুসলমানরা কি পরিমাণ পিছিয়ে ছিল! (কেনো পিছিয়ে ছিল তাও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।)
বেগম রোকেয়া অন্ধ ছিলেন কীভাবে?
আর অন্যর উপর ভরসা করতেন কীভাবে?
বেগম রোকেয়া মুসলমানদের শিক্ষার হার নিয়ে ভূমিকা রাখতে পারতেন। জাতিগত বৈষম্যের শিকার হওয়া মুসলমানদের উন্নতির জন্য কিছু হলেও করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করলেন ঠিক উল্টো।
মুসলমান নারীদেরকে ঘর থেকে বের আনার জন্য এমন কিছু বাদ নেই, যা তিনি করেন নি। মুসলমানদের মধ্যে তখনো শিক্ষা ছিলনা এমন নয়, ছিল। তবে তা পরিপূর্ণ মুসলমানদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্বকে ঘিরে ছিল। যদিও তা ছিল অতি কম। বলা যায় আত্মসম্মানবোধকে শতভাগ রক্ষা করেই ছিল। যেহেতু বৃটিশরাজ ও উ/গ্র হি/ন্দুদের আস্ফালন; সবমিলিয়ে ভাই তার বোনকে বাইরে দিতেন না, মা-বাবা তার মেয়েকে বাইরে দিতেন না। এটা আত্মমর্যাদার ভিতরে পড়ে। পরিস্থিতি ইতিহাস-জানা লোকদের অজানা নয়।
বেগম রোকেরা এসে ঢিলটা ছুঁড়লেন এই জায়গায়। এতটা অন্ধ ছিলেন যে, তিনি মুসলমানদের জাতিসত্তাকে কখনোই ছুঁয়ে দেখেন নি। প্রয়োজনও মনে করেন নি। তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট ও ইসলাম বি/দ্বেষী মনোভাবের লোকদের লেখাজোঁকাকে একদম আপন করে নিয়েছেন। ফলে তার মধ্যে যেই অন্ধত্ব ছিল এটা গাঢ় হয়েছে। বিদ্বেষে ভিতর পূর্ণ হয়েছে। তার সুরকে হিন্দু ও কমিউনিস্ট লেখকরা আমলে নিয়ে সহযোগিতার হাত বৃদ্ধি করেছেন। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের আমলে তিনি হয়ে ওঠেন এক অঘোষিত শক্তি। একসাথে ইসলামের সকল শ/ত্রুর মধ্যমণি হয়ে উঠেন রোকেয়া।
একপর্যায়ে বেগম রোকেয়া বনে গেলেন ‘মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত’! বেগম রোকেয়া কি মুসলিম জাতিসত্তাকে কস্মিনকালেও বহন করতেন? নারী জাগরণের অগ্রদূত হতে পারেন আপত্তি নেই। কিন্তু মুসলিম নারী জাগরণের দূত বললে মেলা আপত্তি আছে! যিনি মুসলিম-ই নয়, তিনি কীভাবে ‘মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হবেন? অন্ততঃ এমন অন্ধ, ধর্মে অজ্ঞ নারী কখনো মুসলিম নারী জাগরণের দূত হতেই পারেন না।
পশ্চিমারা তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’কে কি পরিমাণ রেস্পেক্ট করা হয়েছে বলাবাহুল্য। বহির্বিশ্বে নারীবাদী মানসের জন্য এই বইটিকে ফিল্ম হিশেবেও প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি মূলত সবার চোখের মধ্যমণি হতে পেরেছেন ইসলাম বি/রোধিতা ও নারীবাদী সত্তার কারণে। তার সমসাময়িক আরো অনেক নারী লেখিকা ছিলেন। তাদেরকে এভাবে ফোকাস দেওয়া হয়নি। এভাবে নারী জাগরণের অগ্রদূতও বলা হয়নি। প্রিন্সেস জেবুন্নেসাকে কেউ চিনেও না। কত নারীরা ভারতে থেকে অমর হয়েছেন—তবে বেগম রোকেয়া শুধু অমর হননি, ইসলাম বিদ্বেষের কারণে বহু কিছুও হয়ে গেছেন।
‘অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন, রোকেয়া রচনাবলি’সহ তার একাধিক লেখাজোঁকাই এসবের প্রমাণ।
বেগম রোকেয়া মুসলিম নারী জাগরণের দূত নয়, বরং তিনি ইসলাম ও মুসলিম নারীদের চিরশ/ত্রু। তার লেখাজোঁকাতে একটু নজর বুলালেই স্পষ্ট হওয়া যায়।
তিনি লিখেছেন,
‘তারপর মহাত্মা মহম্মদ আইন প্রস্তুত করিলেন যে, "রমণী সর্বদাই নরের অধীনা থাকিবে, বিবাহের পূর্বে পিতা কিংবা ভ্রাতার অধীনা, বিবাহের পর স্বামীর অধীনা, স্বামী অভাবে পুত্রের অধীনা থাকিবে।" আর মূর্খ নারী নত মস্তকে ঐ বিধান মানিয়া লইল।’
সূত্র: রোকেয়া রচনাবলী, পৃষ্ঠা ৬১১ (২০০৬)
কুরআনকে নবীর বাননো কথা বলে নবীকেই মক করেছেন। প্রকারান্তরে নবী সা. ও কুরআন অস্বীকার।
আরো লিখেছেন,
‘তোমরা দেখিতেছ এই ধর্ম্মশাস্ত্রগুলি পুরুষরচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পাও, কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্ম্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বরপ্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। যদি ঈশ্বর কোন দূত রমণীশাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত কেবল এসিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু…।
সূত্র: রোকেয়া রচনাবলী: পৃষ্ঠা ৫৯৪, ৬১০, ৬১১।
—বেগম রোকেয়া মুসলিম-ই নই। মুসলমানের ঘরে জন্ম হলে কেবল মুসলিম হওয়া যায় না। আদর্শ ও বিশ্বাসকে ধারণ করতে হয়। আমি একজন ইফতাপড়ুয়া হিশেবে নিঃসঙ্কোচে বলছি—রোকেয়ার এমন কথার পর তাকে কোনোভাবেই মুসলিম বলা যায় না। এমন কথা ও বিশ্বাসের পর ব্যক্তি স্পষ্টত ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ জায়গায় জায়গায় পর্দার জন্য হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে পর্দানশীনদেরকে। আশ্চর্যজনক হলেও এটা সত্যি যে, পর্দা ও নিকাব নিয়ে বিদ্বেষ, মকবাজি, টিটকিরি করা—এগুলো রোকেয়ার হাত ধরে শুরু হয়েছে। আগের পরিস্থিতি এমন ছিল না, রোকেয়ার ভীত রচনা রীতিমতো পর্দা ও নিকাবকে ঠাট্টা ও মক করতে উদ্ভুদ্ধ করে। তার বইসমূহ এগুলোকে সমাজে স্বাভাবিক করেছে।
রোকেয়া লিখেছেন,
…..চুপ কর, ঐ দেখ মক্কা মদিনা যায়,-ঐ। ঘেরাটোপ জড়ানো জুজুবুড়ী, ওরাই মক্কা মদিনা।
…চুপ কর। এই রাত্রিকালে ওগুলো ভূত না হয়ে যায় না। বাতাসে বোর্কা নেকাব একটু আধটু উড়িতে দেখিলে বলিত- "দেখরে দেখ। ভূতগুলার শুঁড় নড়ে। বাবারে। পালা রে।"
সূত্র: রোকেয়া রচনাবলী: পৃষ্ঠা ৩৮৫, ৩৮৭, ৪০১
—অবরোধবাসিনী বইটাতে পর্দা-নেকাব, মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক পদ্ধতিকে কি সাংঘাতিক আঘাত করা হয়েছে বলার ভাষা রাখে না।
সুলতানার স্বপ্ন বইটি একরকম পুরুষবিহীন একটি নারীবাদী সমাজের চিত্র এঁকে দেয়। এজন্যই রোকেয়া আজকে এসে এত স্মরনীয় বরণীয়।
স্কুলে পড়াকালীন বেগম রোকেয়াকে কি যে মনে করতাম! এখন তো রীতিমতো গা শিউরে ওঠে—‘মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত’? ডাবল স্ট্যান্ডার্ট না? এতোটা ইসলাম বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম নারীরাই কীভাবে তাকে আইকন হিসেবে নিতে পারে! রোকেয়ার ব্যাপারে রেফারেন্সভিত্তিক সামান্য কথাও নিতে পারে না। অসহ্য লাগে।
অথচ মুসলিম মেয়েরা জানেই না যে—কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একটুকরো নিকাব-হিজাব পরার অধিকার এই বেগম রোকেয়া-ই তুলে নিয়েছেন টিটকিরি ও ঠাট্টা-তামাশা করে! বোরকা ও নিকাবকে শ্রদ্ধা করার পরিবর্তে হয়রানি, মানসিক টর্চার করা শুরু হয়েছে রোকেয়ার হাত ধরে।
লেখক : —মুস্তাফিজ গাজী
কমেন্ট